জেনে নিন পালস অক্সিমিটার সংক্রান্ত খুঁটিনাটি তথ্য

পালস অক্সিমিটার

করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়তেই দেশজুড়ে দিন দিন বেড়ে চলেছে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা। অধিকাংশ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে রক্তে দ্রুত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ার দরুন। তাই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির নিয়মিত রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ মাপা খুবই জরুরি। আর এই জন্যই প্রয়োজন পালস অক্সিমিটারের। আঙুলে লাগিয়ে সহজেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ জানিয়ে দেয় এই যন্ত্রটি।

তাই করোনার মহামারীর দিনে প্রত্যেকের বাড়িতে এই যন্ত্রটি থাকা খুব জরুরি। এমনকি ডাক্তারবাবুরাও পর্যন্ত পরামর্শ দিচ্ছেন এই যন্ত্রটি বাড়িতে রেখে দেওয়ার জন্য। তবে বাজারে এই যন্ত্রটির অনেক নকল বেরিয়েছে এবং মানুষ ঠকেও যাচ্ছে। এছাড়া অনেকে কিনেও যন্ত্রটি ঠিকমত ব্যবহার করতে পারছেন না। তাই আজ আমি আপনাদের এই যন্ত্রটি কীভাবে ব্যবহার করবেন সেই সঙ্গে বেশ কিছু ভালো মানের পালস অক্সিমিটার সম্পর্কে বিস্তারিত জানাব। তাহলে বেশি দেরি না করে আসুন জেনে নিই যন্ত্রটি সম্পর্কিত সমস্ত খুঁটিনাটি অথ্য।

পালস অক্সিমিটার কি?

জ্বর হলে শরীরের তাপমাত্রা মাপার জন্য আমরা যেমন থার্মোমিটার ব্যবহার করি তেমনই রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ মাপার যন্ত্রটি হল পালস অক্সিমিটার। ১৯৫৩ সালে জার্মান চিকিৎসাবিদ কার্ল ম্যাথ এটি সর্বপ্রথম তৈরি করেন। এটি একটি ছোট, ক্লিপ-জাতীয় ইলেক্ট্রনিকস যন্ত্র যা কোনোরূপ যন্ত্রণাদায়ক পরীক্ষা ছাড়াই শরীরের কোন অংশ যেমন হাতের পায়ের আঙুল বা কানের পাতার সঙ্গে লাগিয়ে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ মাপতে সাহায্য করে। এটি সাধারণত হাসপাতালের জরুরি বিভাগে খুব বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে।

পালস অক্সিমিটার

পালস অক্সিমিটার কীভাবে কাজ করে?

ক্লিপের মত দেখতে এই যন্ত্রটির দুটি অংশ থাকে। যন্ত্রটির মাঝখানের নিচের অংশ থেকে লাল এবং ইনফ্রারেড আলো নির্গত হয় এবং মাঝখানের উপরের অংশে একটি সেন্সর বসানো থাকে। এই দুই এর মাঝে আঙুল প্রবেশ করানো হলে লাল এবং ইনফ্রারেড আলো আঙুলের মধ্য দিয়ে সেন্সরে যায় এবং একটি নির্দিষ্ট মেক্যানিজম ব্যবহার করে রক্তে ঠিক কতটুকু অক্সিজেন আছে তা নির্ণয় করে উপরে থাকা ডিসপ্লেতে তা প্রদর্শন করে।

সাধারণত পালস অক্সিমিটারে ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ অক্সিজেন মাত্রাকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ ৯৫ শতাংশের কম হলে চিকিৎসার ভাষায় হাইপোক্সিয়া বলা হয়। শরীরে তখন অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। তখন শ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। সঙ্গে মাথাব্যথা, বুকব্যথা, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে। স্থায়ী হাইপোক্সিয়া দেহের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্ষমতা শেষ করে দেয়। আর এ জন্যই ভেন্টিলেশনের মাধ্যমে অক্সিজেন দিতে হয়। তবে কিছু কিছু দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগের ক্ষেত্রে অক্সিজেনের মাত্রা কিছুটা কম ও স্বাভাবিক ধরা হয়ে থাকে।

পালস অক্সিমিটার ব্যবহারের উদ্দেশ্যঃ

মানুষের রক্তে বিভিন্ন ধরণের রক্তকণিকা থাকে। তার মধ্যে লোহিত রক্তকণিকা অন্যতম। লোহিত রক্তকণিকায় হিমোগ্লোবিন থাকে। আর এই হিমোগ্লোবিন আমাদের শরীরে অক্সিজেন বাহক হিসেবে কাজ করে । অর্থাৎ হিমোগ্লোবিনের মাধ্যমে আমাদের শরীরে অক্সিজেন প্রবাহিত হয়। মূলত রক্তে কী পরিমাণ অক্সিজেন প্রবাহিত হচ্ছে, তা এই যন্ত্রটি দিয়ে মাপা হয় এবং অক্সিজেনের পরিমাণের অবস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের রোগ নির্ণয় করা হয়।

ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমনারি রোগ, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, ফুসফুসের ক্যান্সার, রক্তাল্পতা, হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়া, জন্মগত হার্টের সমস্যায় ভোগা রোগীদের শরীরে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণের উপর নজর রাখতে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়।

এছাড়া শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কোন ব্যক্তির ভেন্টিলেটরের দরকার আছে কিনা জানতে, ফুসফুসের ওষুধগুলি ঠিকমত কাজ করছে তা দেখতে, শল্যচিকিৎসা প্রক্রিয়া চলাকালীন রোগীর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা জানতে এবং কোন ব্যক্তির ঘুমের সময় শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিনা পরীক্ষা করতে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়।

পালস অক্সিমিটার

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে পালস অক্সিমিটার কেন ব্যবহার করা হয়?

করোনা ভাইরাসের আক্রমণের ফলে আমাদের শরীরের ফুসফুস খুব সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীটি সহজে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে না পারার দরুন তার শরীরে অক্সিজেন সরবরাহের মাত্রা কমে যায়। শেষে রোগীর অবস্থা খুব দ্রুত সংকটজনক অবস্থায় পৌঁছে যায়। তাই যদি খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ নির্ণয় করে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়া করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের ভেন্টিলেশন দেওয়া হয়, এই ভেন্টিলেশন ঠিকমত কাজ করছে কিনা সেটিও পালস অক্সিমিটারের সাহায্যে পরীক্ষা করা যায়। যেটি করোনা রোগীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বাধিক পঠিত লেখাসমূহ

পালস অক্সিমিটার ব্যবহারের নিয়ম বিধিঃ

  • সাধারণত এই যন্ত্রটি হাতের আঙুলে, পায়ের আঙুলে কিংবা কানের লতিতে লাগিয়ে অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপ করা হয় তবে ডান হাতের মধ্যমা আঙুলটি ব্যবহার করলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়।
  • যে আঙুলে রক্ত চলাচল কম করে সেই আঙুলে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করলে সেক্ষেত্রে ভুল অক্সিজেনের মাত্রা আসবে।
  • যে হাতের আঙুলে এই যন্ত্রটি ব্যবহার করবেন যদি সেই হাতে ব্লাডপ্রেশার মাপার কাফ লাগানো থাকে তাহলে ভুল রিডিং আসবে।
  • আপনার যদি অ্যানেমিয়া বা রক্তাল্পতা থেকে থাকে, খুব লো ব্লাডপ্রেশার থেকে থাকে সেক্ষেত্রে সঠিক রিডিং আসবে না।
  • হাতের আঙুলে মেহেন্দি, নখে নেইল পলিস লাগানো থাকলে এই যন্ত্রটির ইনফ্রারেড আলো এবং সেন্সর ঠিকমত কাজ করবে না ফলে অক্সিজেনের ভুল মাত্রা দেখাবে।
  • আঙুলের নখ খুব বড় থাকলে আঙুল ঠিকমত এই যন্ত্রটির ভেতরে প্রবেশ করবে না যার ফলে যন্ত্রটি অক্সিজেনের মাত্রা ভুল দেখাবে।
  • হাত পায়ের আঙুল ঠাণ্ডা থাকলে কিংবা আপনি ঠাণ্ডা ঘরে বসে এই যন্ত্রটি দিয়ে অক্সিজেনের মাত্রা মাপলে সেক্ষেত্রে ভুল রিডিং দেখাবে কারণ হাত পা ঠাণ্ডা থাকলে সেখানে রক্ত চলাচল কম করবে, আর এই যন্ত্রটি রক্তের অক্সিজেন মাপে তাই রিডিং ভুল দেখাবে।
  • কিছু রোগের কারণে এই যন্ত্রটি দিয়ে অক্সিজেন মাপলে ভুল রিডিং আসতে পারে। যেমন কোন রোগীর হার্টের পাম্প করার ক্ষমতা কম থাকে তাহলে ভুল রিডিং আসতে পারে। আবার অনেক ডায়াবেটিস রোগীর হাতে পায়ে রক্ত চলাচল কম হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে ভুল রিডিং আসবে।
  • অক্সিজেনের লেভেল ৭০ এর নিচে নেমে গেলে যন্ত্রটি তখন ঠিকঠাক কাজ করে না।
  • যন্ত্রটি ঠিকঠাক ভাবে না লাগালে, বেঁকে থাকলে, হাত কাঁপলে ভুল রিডিং আসতে পারে।
  • খুব উজ্জ্বল আলোতে এই যন্ত্রটি দিয়ে অক্সিজেন মাপলে রিডিং সঠিক নাও আসতে পারে।
  • যদি যন্ত্রটির সেন্সরে এবং যেখান থেকে আলোগুলো নির্গত সেখানে নোংরা জমে গেলে ভুল রিডিং আসতে পারে।
  • ব্যাটারির পাওয়ার কমে গেলেও অক্সিজেনের ভুল মাত্রা দেখাতে পারে।

পালস অক্সিমিটার কেনার গাইডঃ

বাজারে সস্তায় অনেক পালস অক্সিমিটার পাওয়া গেলেও সেইগুলো ঠিকমত কাজ করে না। বেশির ভাগই জাল কিংবা নকল। আশ্চর্যের বিষয় এই নকল যন্ত্রগুলো পেনের অক্সিজেনের মাত্রা বলে দেয়। এরচেয়ে হাস্যকর ব্যাপার আর কি আছে। তাই বন্ধুরা আপনারা যাতে ঠকে না যান সেই জন্য আমি আপনাদের ৩টি সেরা বাছাই করা পালস অক্সিমিটারের নাম জানাবো এবং সেই সঙ্গে কেনার লিংক শেয়ার করব, যাতে আপনাদের কোন ঠকে যাওয়ার ভয় না থাকে। তাহলে দেরি না করে শুরু করা যাক।

ডঃ ট্রাস্ট প্রফেশনাল সিরিজ ফিঙ্গারটিপ পালস অক্সিমিটার

আমার তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকা আমার তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকা  ডঃ ট্রাস্ট প্রফেশনাল সিরিজ ফিঙ্গারটিপ পালস অক্সিমিটারটি আপনার রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ (SPO2), পারফিউশন সূচক(PI), নাড়ির হার(PR) এবং নাড়ীর বার গ্রাফটি সঠিকভাবে নির্ধারণ করে। সাথে শ্বাসযন্ত্রের হারও নির্ণয় করতে পারে।

এছাড়া এই যন্ত্রটিতে রয়েছে জলপ্রতিরোধী ব্যবস্থা, উন্নত ডিজিটাল বড় OLED ডিসপ্লে এবং আপনাকে বিপদ থেকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য অডিও ভিজুয়াল এলার্মিং সিস্টেম।

পালস অক্সিমিটার

ডঃ ট্রাস্ট সিগনেচার সিরিজ ফিঙ্গারটিপ পালস অক্সিমিটার

আমার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা ডঃ ট্রাস্ট সিগনেচার সিরিজ ফিঙ্গারটিপ পালস অক্সিমিটারটি আপনার রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ(SPO2), পারফিউশন সূচক(PI), নাড়ির হার(PR) এবং নাড়ীর বার গ্রাফটি সঠিকভাবে নির্ণয় করে।

এই যন্ত্রটিতে ডিজিটাল OLED ডিসপ্লে এবং আপনাকে বিপদ থেকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য এলার্মিং সিস্টেম থাকলেও শ্বাসযন্ত্রের হার নির্ণয় করা এবং জলপ্রতিরোধী ব্যবস্থা এই ফিচারগুলো অনুপস্থিত।

পালস অক্সিমিটার

ডঃ ভাকু ফিঙ্গারটিপ পালস অক্সিমিটার

আমার তালিকায় তৃতীয় স্থানে থাকা ডঃ ভাকু ফিঙ্গারটিপ পালস অক্সিমিটারটি আপনার রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ(SPO2), পারফিউশন সূচক(PI), নাড়ির হার(PR) খুব তাড়াতাড়ি এবং সঠিকভাবে নির্ণয় করে।

এছাড়া এই যন্ত্রটিতে রয়েছে বড় ডিজিটাল LED ডিসপ্লে। তবে এলার্মিং সিস্টেম, শ্বাসযন্ত্রের হার নির্ণয় করা এবং জলপ্রতিরোধী ব্যবস্থা এই ফিচারগুলো নেই।

পালস অক্সিমিটার

সর্বশেষ একটাই কথা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গেছেন ভেবে অযথা প্যানিক হবেন না। তাহলে আপনার শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এই বোধ বারবার অনুভব করবেন। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিন। অনেক সময় অন্য কারণেও আপনার শ্বাসকষ্ট হতে পারে। আর হ্যাঁ এই যন্ত্রটি কখনই আপনি করোনা পজিটিভ কিনা তা নির্ণয় করতে পারে না। এই যন্ত্রটি করোনা ভাইরাস ধরতে পারে এই ভ্রান্ত ধারণা অনেক মানুষের মধ্যে এখনও আছে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন।

লেখাটি ভালো লাগলে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না এবং লেখাটি আপনার কোন উপকারে এলে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে শেয়ার করে অন্যদের পড়ার সুযোগ করে দিন।

Leave a Comment

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Scroll to Top
Scroll to Top